লিভার নষ্টের লক্ষণ ও লিভার ক্যান্সার লক্ষণ এবং লিভার রোগের চিকিৎসা | By Healthybangaly

লিভারের কাজ কি

মানুষের লিভার কোথায় থাকে ও লিভার রোগের লক্ষণ

লিভার পরীক্ষা লিভার টেস্ট খরচ কত লিভার ব্যাথা লিভার পরীক্ষার নাম লিভারের হোমিও ঔষধ  ভারতে লিভার সিরোসিস চিকিৎসা হামদর্দ এর লিভারের ঔষধ লিভার রোগের হোমিও চিকিৎসা ফ্যাটি লিভারের ঔষধ ভারতে লিভার সিরোসিস চিকিৎসা লিভার বড় হওয়ার লক্ষণ লিভার সমস্যা ও সমাধান

লিভার এর ছবি

লিভার কি কাজ করে

লিভার শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্ববৃহত অঙ্গ। শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রয়োজন সুস্থ লিভার। লিভারকে বলা হয় শরীরের পাওয়ার হাউজ যা জীবন ধারনের জন্য অপরিহার্য। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে লিভারের ওজন ১ থেকে ১.৫০ কেজি। লিভারকে আল্লাহপাক পাওয়ার স্টেশন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। 

আমাদের মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি সবগুলি যন্ত্রের সুষ্ঠু কাজের ক্ষমতা নির্ভর করে লিভার থেকে নির্গত শক্তির ওপর। আমরা যা খাই, যেমন:শর্করা, আমিষ, চর্বিজাতীয় পদার্থ, খনিজদ্রব্য ইত্যাদি সব ভেঙ্গে একমাত্র লিভারই প্রক্রিয়াজাত করে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উপাদানগুলোকে শরীরের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে, নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে লিভার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সরবরাহ করে। 

মানুষের রক্তের মধ্যে Coagulation Factors নামে প্রবাহিত অসংখ্য কেমিক্যালস রয়েছে, যা রক্তকে সঞ্চালিত রাখে। সব ক’টি Coagulation Factors শুধু লিভার থেকে তৈরি হয়। রক্তের সঞ্চালন এবং জমাট বাঁধার ক্ষমতা একমাত্র লিভারের কার্যক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। আমরা যা কিছু খাই, সেই খাবারগুলো পরিপাকতন্ত্রে প্রাথমিক হজমের জন্য পিত্তরস অপরিহার্য। পিত্তরস ছাড়া খাদ্যবস্তু হজম সম্ভব নয়। এই পিত্তরস শুধু লিভার কোষ তৈরি করে।

আপদকালীন ব্যবহারের জন্য ভিটামিন এ, ডি, ই-কে লিভারে জমা থাকে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় আয়রন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি লিভারে জমা থাকে। 


সাবধাণতাঃ

লিভার শরীরের সর্ববৃহৎ অঙ্গ। আকৃতিতে যেমন বৃহৎ, প্রয়োজনীয়তার দিক থেকেও এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। শরীরকে সুখে রাখতে দরকার সুস্থ লিভার। অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত লিভার শুধু স্বাস্থ্যহানিই নয়, জীবনহানিরও কারণ হতে পারে। তাই সচেতন থাকা দরকার লিভারের ব্যাপারে।

লিভারের রোগ ও লিভার রোগের কারণ

লিভার কিছু বংশগত অথবা কিছু অর্জিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রোগগুলো স্বল্পস্থায়ী আবার কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে চিকিৎসা করা সত্ত্বেও জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারণ করতে পারে।

হেপাটাইটিস বা লিভারে প্রদাহ বিশ্বজুড়ে লিভারের প্রধান রোগ। নানা কারণে এই প্রদাহ হতে পারে। যার অন্যতম কারণ এ, বি, সি, ডি, ই নামক হেপাটাইটিস ভাইরাস। পানি ও খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাস লিভারে একিউট হেপাটাইটিস বা স্বল্পস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সেরে যায়। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি ভাইরাস। ভাইরাস ছাড়াও অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান, লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া, বিভিন্ন ড্রাগ ও কেমিক্যালস হেপাটাইটিস করে থাকে। অটোইমিউন হেপাটাইটিস, উইলসন্স ডিজিজসহ বিভিন্ন অজানা কারণজনিত রোগ ও বংশগত রোগে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।

যে কারণেই প্রদাহ সৃষ্টি হোক না কেন, দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক হেপাটাইটিস বছরের পর বছর চলতে থাকলে লিভারের কোষগুলো মরে যায়। অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় ফাইব্রাস টিস্যু সে স্থান দখল করে জন্ম দেয় সিরোসিস নামক মারাত্মক রোগ। সিরোসিস হলে লিভারের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বি এবং সি সংক্রমণই লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ। আমাদের দেশে অতিরিক্ত মদ বা অ্যালকোহল পানজনিত হেপাটাইটিস সিরোসিসের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী। ডায়াবেটিস, রক্তের চর্বির উচ্চমাত্রা প্রভৃতি কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মতো লিভারেও ফ্যাট জমে হয় ফ্যাটি লিভার। ইদানীং ফ্যাটি লিভার, লিভারের সিরোসিসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ব্যাকটেরিয়া এবং প্যারাসাইট লিভারে অ্যাবসেস বা ফোঁড়া তৈরি করতে পারে। সর্বোপরি প্রাণঘাতী ক্যান্সারও ভর করতে পারে লিভারে। সিরোসিস যাদের হয় তাদের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

হেপাটাইটিস ভাইরাস কিভাবে ছড়ায় 

দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে হেপাটাইটিস ছড়ায়। শহরে পানি সরবরাহ লাইনে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে জন্ডিস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও নতুন কিছু নয়। তাই ফুটিয়ে পানি খাওয়া আর বেছে-বুঝে খাবার খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এতে শুধু হেপাটাইটিস এ এবং ই নয় টাইফয়েড আর ডায়রিয়ার মতো আরও অনেক পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচা যাবে।

দূষিত রক্ত গ্রহণ বা দূষিত সিরিজ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেকেই নিজের অজান্তে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। একই শেভিং রেজার, বেল্গড কিংবা ক্ষুর ব্যবহারের মাধ্যমে এ দুটি ভাইরাস ছড়াতে পারে। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের সন্তানের জন্মের পরপর বি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ। তবে মায়ের দুধের মাধ্যমে বি ভাইরাস ছড়ায় না। সামাজিক মেলামেশা যেমন হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি এবং রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন গল্গাস জামাকাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না।

হ্যাপাটাইসিস রোগের লক্ষণ

একিউট হেপাটাইটিসে ক্ষুধামন্দা, শরীর ব্যথা, বমির ভাব কিংবা বমি এবং কিছুদিনের মধ্যে প্রস্রাবের রঙ ও চোখ হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এ সময় শরীরে চুলকানি দেখা দিতে পারে। জন্ডিস ক্রমে বেড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বা সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে বেশিরভাগ রোগীর উপসর্গ থাকে না বললেই চলে। কেউ কেউ দুর্বলতা, অবসন্নতা বা ক্ষুধামন্দা অনুভব করতে পারে। হেপাটাইটিস বি ও সি অনেকাংশই নিরাময়যোগ্য রোগ হলেও অ্যাডভ্যান্সড লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগী প্রায়ই কোনো শারীরিক অসুবিধা অনুভব করে না। এসব রোগীকে পেটে পানি জমে পেট ফুলে যেতে পারে, রক্তবমি বা কালো পায়খানা কিংবা অজ্ঞান হয়ে জীবনঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। 


লিভারের রোগে করনীয় কি

লিভারের রোগীর কোনো উপসর্গ দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে অথবা আপনার শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হলে দেরি না করে লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। হেপাটাইটিস এ ও ই-জনিত রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জটিলতাও দেখা দিতে পারে। হেপাটাইটিস ই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩০ শতাংশ গর্ভবতী মা মারা যান, যখন শেষ তিন মাসের সময় মা তীব্রভাবে হেপাটাইটিস ই প্রদাহে ভোগেন। অন্যদের ক্ষেত্রে জীবনসংহারী একিউট হেপাটিক ফেইলিউর নামক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই জন্ডিসকে কখনও অবহেলা করবেন না।

লিভার রোগের লক্ষণ

লিভার দেহের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের শরীরের বিপাকীয় কার্যাবলী লিভারই সম্পাদন করে। এই অঙ্গ থেকে নিসৃত রসেই খাবার হজম হয়। যাদের লিভার দুর্বল, তাদের পেটে সারাবছর সমস্যা লেগেই থাকে। গবেষকের মতে, লিভারের রোগকে নীরব ঘাতক বলা হয়। কেননা লিভারের যেকোনো রোগ সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে না। রোগ বেড়ে গেলে এর লক্ষ্মণ প্রকাশ পায়। অনেক সময় তখন আর কিছু করার থাকে না। 

-লিভার ভালো না থাকার লক্ষণগুলো জেনে নিন-


লিভার রোগের কিছু লক্ষণ


দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাসঃ- মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকার পরেও যদি আপনার নিঃশ্বাসের সঙ্গে দুর্গন্ধ বের হয় তাহলে বুঝবেন যে আপনার লিভারের কোনো সমস্যা আছে। লিভারের স্বাস্থ্য ভালো না থাকার একটি লক্ষণ এটি।

অকারণে ওজন বেড়ে যাওয়াঃ- লিভার যেহেতু চর্বি হজমের জন্য প্রধানত দায়ী সেহেতু এটি যথাযথভাবে কাজ না করলে দেহে চর্বি জমতে থাকে। যার ফলে ব্যাখ্যাতীতভাবে অকারণে ওজন বাড়তে থাকে।

অ্যালার্জিঃ- লিভার ভালো থাকলে তা এমন সব অ্যান্টিবডি তৈরি করে যেগুলো অ্যালার্জেন বা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদানগুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে। কিন্তু লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে দেহ ওই অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদানগুলোকে জমা করতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় আবার দেহ হিস্টামিন উৎপাদন করতে থাকে যা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারক উপাদানগুলো দূর করতে কাজ করে। কিন্তু অতিরিক্ত হিস্টামিন উৎপাদন হলে আবার চুলকানি, ঝিমুনি এবং মাথা ব্যথা হতে পারে।


ক্রমাগত অবসাদঃ- দেহে টক্সিন জমা হলে তা মাংসপেশির টিস্যুর বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে। যা থেকে আবার ব্যাথা এবং শারীরিক অবসাদও সৃষ্টি হতে পারে। ক্লান্তি থেকে মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মানসিক অবসাদ এবং ক্ষোভের বিস্ফোরণের মতো সমস্যাও তৈরি হতে পারে। লিভার ভালো না থাকার শীর্ষ লক্ষণগুলোর একটি এটি। দেহে অতি উচ্চ মাত্রায় টক্সিন বা বিষ জমা হওয়ারও একটি লক্ষণ এটি।


অতিরিক্ত ঘাম বের হওয়াঃ- বেশি বেশি কাজ করার কারণে লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং সেটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখন লিভার দেহের অন্যান্য অঙ্গেও তাপ ছড়িয়ে দেয় এবং অতিরিক্ত ঘাম বের করার মাধ্যমে লিভার নিজেকে ঠাণ্ডা করে।


ব্রণঃ- লিভারে জমা হওয়া টক্সিন দেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে যা থেকে ত্বকে ব্রণ সৃষ্টি হতে পারে। কার্যক্ষমতা হারানো লিভারের কারণে সৃষ্ট ত্বকের এই সমস্যা ততক্ষণ পর্যন্ত যাবে না যতক্ষণ না পুনরায় লিভারের কার্যক্ষমতার উন্নতি ঘটানো হবে।


চোখ হলদে হয়ঃ- ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের মেডিক্যাল পরিচালক ডা. কেভি নারায়ানান মেনন বলেন, হলদে চোখ হল একটি উপসর্গ যাতে বুঝা যায় যে লিভার ভালোমতো কাজ করছে না এবং এটি সম্ভবত লিভার ডিজিজ বা যকৃত রোগের সবচেয়ে নির্দিষ্ট উপসর্গ। বিলিরুবিন নামক হলুদ রঙয়ের একটি পদার্থ সাধারণত লিভার দ্বারা বিকল হয়ে শরীর থেকে অপসারিত হয়ে যায়।


পেট তরলে ভরে যায়ঃ- আপনার পেট যদি হঠাৎ ফুলে যায় এবং তা যদি না থামে, তাহলে এটি সাধারণ ব্লোটিং বা পেট ফোলার চেয়েও বেশি ফুলে যেতে পারে। ডা. বলেন, লিভারের আশেপাশের রক্তনালীসমূহের মধ্যে বর্ধিত চাপ পেটের ভেতর তরল জমা করতে পারে। গ্যাস, খাবার কিংবা তরলের কারণে আপনার পেট ফুলে গেছে কিনা জানতে ডাক্তার দেখানো গুরুত্বপূর্ণ।


চুলকানি থামাতে পারেন নাঃ-

আপনি বিশ্বাস করুন কিংবা না করুন, একটি অসুস্থ লিভার শরীরের সর্বত্র চুলকানির উদ্রেক করতে পারে। ডা. মেনন বলেন, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না, কিন্তু এটি বাইল সল্ট বা পিত্ত লবণের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। পিত্ত হচ্ছে লিভার দ্বারা উৎপাদিত পাচন পদার্থ, কিন্তু প্রাইমারি বিলিয়ারি সিরোসিস (একটি অটোইমিউন যকৃত রোগ যা বাইল ডাক্ট বা পিত্তনালীকে বন্ধ করে দেয়) রোগে আক্রান্তদের মধ্যে পিত্ত জমা হতে থাকে এবং শরীরে উল্লেখযোগ্য উপসর্গ  যেমন- চুলকানি দেখা দেয়।


প্রতিনিয়ত ক্লান্তঃ-

দীর্ঘায়িত ক্লান্তি এমন একটি উপসর্গ যা প্রায় সবসময় শরীর যে ভালো নেই তা নির্দেশ করতে পারে। লিভার ডিজিজ বা যকৃত রোগ হলেও প্রতিনিয়ত ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন।


লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ

অন্য ক্যান্সারের মতোই লিভার ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়না। ক্যান্সার কোষ ক্রমশ বড় হতে থাকলে বা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। লিভার ক্যান্সারের এমন কিছু সাধারণ লক্ষণের কথাই আজ বলবো।


১. পেটে ব্যথাঃ- যদি আপনার পেটে ব্যথা অনুভব করেন, বিশেষ করে পেটের ডান পাশে নিয়মিত ব্যথা হলে তা হতে পারে লিভার ক্যান্সারের জন্য। একজন অনকোলজিস্ট বা লিভার বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলুন সঠিক কারণ জানার জন্য এবং নিরাময়ের জন্য।

২. পেটে কোন ফোলা বা পিন্ড দেখা গেলেঃ- উপরের বা নীচের পেটে ফোলা বা পিন্ডের মত অংশ দেখা দিলে তা হতে পারে লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ। এর পাশাপাশি পেট ভরা থাকার অনুভূতি থাকলে তা লিভার ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণ হতে পারে।


৩. পেট ফুলে যাওয়াঃ- পেট ফুলে গেলে তা অবহেলা করা উচিৎ নয়। কারণ এটি হতে পারে ক্যান্সার কোষের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে অথবা লিভারে তরল জমে যাওয়ার কারণে। এর ফলে পেটে ও লিভারের মধ্যে চাপ বৃদ্ধি পায়। এতে শুধু লিভারের কাজেই প্রভাব পড়েনা বরং লিভারের অকার্যকারিতাও দেখা দিতে পারে।


৪. জন্ডিসঃ- যদিও জন্ডিসে আক্রান্ত হলেই তা লিভার ক্যান্সারের জন্য হবে এমন নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি লিভার ড্যামেজের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ করে। যা পরবর্তীতে লিভার ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে। ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, ফ্যাকাসে মল ও গাঁড় প্রস্রাব হলে অবহেলা করা উচিৎ নয় বরং দ্রুত নিরাময়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।


৫. অবসাদঃ- অবসাদ অনুভব করা লিভার ক্যান্সারের তেমন কোন তীব্র লক্ষণ প্রকাশ করেনা। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্রাম নেয়ার পরেও অনেক বেশি ক্লান্ত অনুভব করা অথবা দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজ করলেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লে অবহেলা করা উচিৎ নয়। এগুলোর পাশাপাশি যদি পেটে ব্যথা ও জ্বর থাকে তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।


৬. জ্বরঃ- জ্বরকে লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ হিসেবে গণ্য করাটা কঠিন। কারণ অনেক রোগের বা ইনফেকশনের সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। পেট ফুলে যাওয়া বা পেটে ব্যথা হওয়ার সাথে যদি নিম্ন মাত্রার জ্বরে ভুগে থাকেন তাহলে আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন মূল কারণ নির্ণয়ের জন্য।


৭. ক্ষুধা কমে যাওয়াঃ- কিছু ক্ষেত্রে পেট ভরা অনুভব করা বা ক্ষুধা কমে যাওয়া লিভার ড্যামেজের বা লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। ক্ষুধা কমে গেলে শরীরের ওজন কমে যায়। শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের না হয়ে লিভারের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করে বলে এমন হয়।



লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা ও করণীয়

লিভার ক্যান্সার নির্ণয়ে সহজ উপায় একটি নির্ভরযোগ্য আল্ট্রাসনোগ্রাম। তবে কখনো কখনো সিটি-স্ক্যানেরও দরকার পরে। রক্তের AFP পরীক্ষাটি লিভার ক্যান্সারের একটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য টিউমার মার্কার। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত যে কোন ব্যক্তিরই উচিত প্রতি ৬ মাসে একবার AFR ও আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা। তবে লিভার ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস কনফার্ম করতে হলে আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডেড FNAC অত্যন্ত জরুরি আর অভিজ্ঞ হাতের সাফল্যের হারও প্রায় শতভাগ। 

এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। শুরুতে ধরা পরলে আর আকারে ছোট থাকলে অপারেশনের মাধ্যমে এই টিউমার লিভার থেকে কেটে বাদ দেয়া যায়। আর এর জন্য প্রয়োজনীয় কুসা মেশিন ও দক্ষ হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন এদেশেই বিদ্যমান। পাশাপাশি আছে বিনা অপারেশনে টিউমার অ্যাবলেশন বা টিউমারকে পুরিয়ে দেয়া। নামমাত্র খরচে আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডে আমাদের দেশে এখন অহরহই লিভার ক্যান্সারের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন করা হয়। পাশাপাশি আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডে সস্তায় অ্যালকোহল দিয়েও অ্যাবলেশন বা টিউমার পুড়িয়ে ছোট করে দেয়া সম্ভব। আছে আরও কিছু আশা। 

যেমন এসেছে আগের চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর, কিন্তু অনেক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কেমোথেরাপি জেলোডা ও সুরাফিনেব। এই দুটি ওষুধ আমাদের দেশে তৈরিও হচ্ছে। লিভার ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসা এদেশে নিয়মিত হচ্ছে। আর তাই লিভারের ক্যান্সারে শেষ হয়নি আশা।

লিভার অ্যাবসেস 

লিভার অ্যাবসেস বা লিভারের ফোঁড়া মানব দেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ একটি রোগ। লিভারে দুধরনের ফোঁড়া হয়, পায়োজেনিক ও অ্যামিবিক। ইকোলাই, স্টাফাইলোকক্কাই, স্ট্রেপ্টোকক্কাই, ক্লেবসিয়েলা ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া পায়োজেনিক লিভার অ্যাবসেসের জন্য দায়ী, আর অ্যামিবিক লিভার অ্যাবসেস হয় অ্যামিবা থেকে। তবে এসব জীবাণু ঠিক কী কারণে লিভারে ফোঁড়া তৈরি করে তা সব সময় জানা যায় না। তবে ডায়াবেটিস, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, গ্যাস্ট্রোএন্টাররাইটিস, রক্তের ইনফেকশন, নবজাত শিশুর নাভির ইনফেকশন, অতিরিক্ত মদ্যপান, পেটে আঘাত পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে লিভারে ফোঁড়া হতে পারে। একজন রোগীর লিভারে একটি বা একাধিক ফোঁড়া থাকতে পারে।


লিভার অ্যাবসেস রোগের লক্ষণ

লিভারের ফোঁড়ার কোনো বিশেষ লক্ষণ নেই। রোগীদের সাধারণত খাবারে অরুচি, জ্বর ও পেটে ব্যথা থাকে। অনেক সময় কাশি কিংবা ডান কাঁধে ব্যথা থাকতে পারে। বিরল ক্ষেত্রে রোগীর জন্ডিস হতে পারে।


লিভার অ্যাবসেস হলে করণীয় ও চিকিৎসা

লিভার অ্যাবসেসের জন্য মূল পরীক্ষা হলো পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগের শুরুতে আল্ট্রাসনোগ্রামে অ্যাবসেস ধরা পড়ে না। এ জন্য ৭ থেকে ১০ দিন পর আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপিট করলে ভালো। লিভার অ্যাবসেস সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকেই সেরে যায়। তবে লিভার থেকে পুঁজ বের করে দেয়াটা জরুরি। বিশেষ করে লিভারে যদি বড় বা একাধিক অ্যাবসেস থাকে। এক সময় এর জন্য অপারেশনের প্রয়োজন পড়লেও আজ আর তার দরকার পড়ে না। এখন লোকাল অ্যানেসথেসিয়া করে খুব অল্প খরচে আল্ট্রাসনোগ্রাফি গাইডেনসে লিভার থেকে পুঁজ বের করা সম্ভব। এরপর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে লিভারের ফোঁড়া সেরে যায়।

লিভার সিরোসিস 

লিভার সিরোসিস একটি মারাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য রোগ। তবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে লিভার সিরোসিস থেকে অনেকটা দূরে থাকা যায়। এতে যকৃৎ বা লিভারের কোষকলা এমনভাবে ধ্বংস হয়ে যায় যে তা সম্পূর্ণ বিকৃত ও অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং প্রদাহ এর কারণে লিভারে ফাইব্রোসিস এবং নুডিউল বা গুটি গুটি জিনিস তৈরি হয় ফলে লিভার এর যেসব স্বাভাবিক কাজ আছে যেমন:-

বিপাক ক্রিয়া, পুষ্টি উপাদান সঞ্চয়, ওষুধ ও নানা রাসায়নিকের শোষণ, রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ তৈরি ইত্যাদি কাজ ব্যাহত হয়। দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। এ ছাড়া কিছু জন্মগত অসুখের কারণেও এই সমস্যা হয়ে থাকে যেমন, ওইলসন ডিজিজ, হেমোক্রোমেটাসিস ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এই রোগ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। তাই সকলের আগে থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন।



লিভার সিরোসিসের লক্ষণ

প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়তে দেরি হয় তবে সাধারনত রক্তস্বল্পতা, রক্ত জমাট বাঁধার অস্বাভাবিকতা, যকৃতে বেশি পরিমাণে জৈব রসায়ন, বেশি বিলুরুবিন, কম সিরাম অ্যালবুমিন ইত্যাদি সমস্যা ধরা পড়তে পারে। সিরোসিস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম ও যকৃতের বায়োপসি করতে হয়। সাধারণত খাদ্যে অরুচি, ওজন হ্রাস, বমি ভাব বা বমি, বমি বা মলের সঙ্গে রক্তপাত, শরীরে পানি আসা ইত্যাদি হলো মূল উপসর্গ। পরে যকৃতের অকার্যকারিতার সঙ্গে কিডনির অকার্যকারিতা, রক্তবমি, রক্তে আমিষ ও লবণের অসামঞ্জস্য ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়।


লিভার সিরোসিস হলে করণীয় ও চিকিৎসা

লিভার সিরোসিস চিকিৎসার মূল বিষয় হচ্ছে প্রতিরোধ। যেসব কারণে লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে, বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি-এর যেহেতু প্রতিশেধক আছে। তাই আমাদের উচিত প্রত্যেকেরই এই প্রতিশেধক নেওয়া। পাশাপাশি কিছু সচেতনতা জরুরি। দূষিত কোনো সূঁচ বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা, কোনো দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালন না করা পাশাপাশি সেলুনে সেভ করাসহ যেকোনো কাটাকাটি বা সেলাইয়ের সময় এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। রোগীদের কাছ থেকে সরাসরি এই ভাইরাস সংক্রমিত হয় না।

ফ্যাটি লিভার 

লিভার কোষে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে যা তার গাঠনিক উপাদানের ৫ থেকে ১০ শতাংশ তাকে ফ্যাটি লিভার বলে। যখন কোনো মানুষ তার দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত চর্বি খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করে, তখন এ চর্বি ধীরে ধীরে তার কলা বা টিসুতে জমতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মদ্যপানের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু যাঁরা মদ্যপানের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদেরও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত মধ্যবয়সী মহিলাদের দেখা দেয়। স্থূলতা ফ্যাটি লিভারের একটি প্রধান কারণ। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি (হাইপার লিপিডেমিয়া), বংশগত, ওষুধ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন, মদ বা অ্যালকোহল, স্টেরয়েড, টেট্রাসাইক্লিন এবং কার্বন টেট্রাক্লোরাইড ইত্যাদি কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে। যাদের ওজন আদর্শ ওজনের ১০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি, তাদের ফ্যাটি লিভার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। মুটিয়ে গেলে শিশুদেরও এ রোগ হতে পারে।


ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ


রোগীরা সাধারণত ক্লান্তি, অবসাদ, ওপরের পেটের ডান দিকে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারদের কাছে আসেন। পরীক্ষা করলে দেখা যায়, রোগীদের এসজিপিটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এদের বিলুরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, লিভারে অ্যানজাইমের মাত্রা স্বাভাবিক অথচ লিভারের আল্ট্রাসনোগ্রামে চর্বির মাত্রা বেশি।


ফ্যাটি লিভার হলে করণীয় ও চিকিৎসা

পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম, লিভার বায়োপসি পরীক্ষা করলে রোগটি নির্ণয় করা যায়। যদি লিভারের এনজাইমগুলো বেড়ে যায়, তখন বুঝতে হবে, তার ক্ষেত্রে এই ফ্যাটি লিভারের কারণে দীর্ঘমেয়াদি অসুখ হওয়া আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রোগির জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করতে হবে, ওজন কমাতে হবে এবং কিছু ওষুধ খেতে হবে। আর যদি শুধু ফ্যাটি লিভার থাকে, পাশাপাশি লিভারের অন্যান্য কার্যক্রম যদি ভালো থাকে, যদি খুব বেশি স্থূলকায় না হোন, তাহলে শুধু একটু জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করলে হয়। সুষম খাবার, কায়িক পরিশ্রম, নিয়মিত ব্যায়াম—এগুলো করলে ভালো থাকবেন।

লিভার ড্যামেজ হওয়ার ৬টি কারণ 

শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে লিভার। শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বাহির করে দেয় লিভার। এই জন্য এই অঙ্গটি প্রচুর চাপের মধ্যে এবং ইনফেকশনের ঝুঁকিতে থাকে। তাই লিভার ডিজিজ বা হেপাটাইটিস প্রতিরোধের জন্য লিভারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা জরুরী।

লিভার ড্যামেজের লক্ষণগুলো বুঝতে পারলে প্রাথমিক অবস্থায় লিভার ফেইলিউর এর অগ্রগতি প্রতিহত করা যায়।

লিভার ড্যামেজের লক্ষণ


১। ক্ষুধামন্দা
যকৃতের সমস্যার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে ক্ষুধা কমে যাওয়া। লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেহে টক্সিক উপাদানের সঞ্চয় হতে থাকে। যার বিরূপ প্রভাবে ক্ষুধা কমে যায়। এছাড়াও এর ফলে ভিটামিন ও মিনারেলের শোষণ বাধাগ্রস্থ হয়। পরিণতিতে দুর্বলতা ও অবসাদগ্রস্থ হতে দেখা যায়। যদি এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ক্ষুধামন্দায় ভুগে থাকেন তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

২। বমি
লিভার ড্যামেজের আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া। লিভাবের বিষাক্ততার জন্যই বদহজম ও পেটের সমস্যা হয়। যার ফলশ্রুতিতে ক্রমাগত বমি হয়। যদি কোন কিছু খাওয়ার বা পান করার সাথে সাথে বমি বমি ভাব হয় বা বমি হয় তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

৩। চোখের বিবর্ণতা
জন্ডিস বা হেপাটাইটিসের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হচ্ছে চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া। বিশেষ করে সকালে চোখের বিবর্ণতা দেখা গেলে তা লিভার ড্যামেজের লক্ষণ বুঝায়। তাই চোখের কোন পরিবর্তন গুরুত্ব সহকারে নেয়া প্রয়োজন। কারণ এর দ্বারা বোঝা যায় আপনার যকৃত ঠিকভাবে কাজ করছেনা।

৪। ডার্ক ইউরিন
যখন যকৃত ঠিকভাবে কাজ করেনা তখন পিত্ত লবণের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। পিত্ত লবণকে ভাঙ্গার জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইমের অনুপস্থিতিই শরীরে পিত্ত রঞ্জকের উপস্থিতি দেখা যায়। যা মল-মুত্রের সাথে বের হয়ে যায়। এই রঞ্জকগুলো কিছুটা গাঢ় রঙের হয়। তাই মুত্রের বর্ণ হালকা হলুদ থেকে গাঢ় হলুদ বর্ণের হয়। এটি লিভার ড্যামেজের একটি দৃশ্যমান লক্ষণ।

৫। পেট ব্যথা ও ফুলে যাওয়া
পেটের উপরের দিকের ডানপাশে যকৃত অবস্থিত। শরীরের এই অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি হলে তা লিভার ড্যামেজের স্পষ্ট লক্ষণ। পেট ফাঁপার সমস্যা দেখা দেয় যা লিভার ফুলে যাওয়াকে নির্দেশ করে। এই রকম লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

৬। পা ফুলে যাওয়া
লিভার ড্যামেজের ক্ষেত্রে পা ফুলে যেতে পারে এবং এই সমস্যাটির বিষয়ে অনেকেই সচেতন না। যকৃত যদি ঠিক ভাবে বিষাক্ত পদার্থ শরীর থেকে বাহির করে দিতে না পারে তাহলে সেগুলো শরীরে জমতে থাকে এবং রক্ত প্রবাহকে বাঁধা দেয়। এই বিষাক্ত পদার্থ গুলো শরীরের বিভিন্ন অংশে জমা হয় এবং এদের বেশিরভাগই জমা হয় পায়ে। এর ফলশ্রুতিতেই পা ফুলে যায় বা এডিমা হয়।


কি কারণে লিভার নষ্ট হয়

একটি শরীরকে সুস্থ রাখার পিছনে লিভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই লিভারের কোষগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, যার কারণে এটি ঠিকমত কাজ করতে পারে না। লিভারের কোষ নষ্ট করার পিছনে কিছুটা আমরা নিজেরাই দায়ী। জেনে নিন আমাদের নিজেদের কিছু অভ্যাস যা লিভার নষ্ট করে দিয়ে থাকে।

১। মদ্যপান
লিভার নষ্ট হওয়ার খুব সাধারণ একটি কারণ হল অতিরিক্ত মদ্যপান। অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের বিষাক্ত পদার্থ দূর করার ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। অ্যালকাহোলের উপদানসমূহ কারণে লিভারে চর্বি জমে যায়। যার কারণে লিভার ড্যামেজ, ফ্যাটি লিভার, এমনকি লিভার ক্যান্সারের মত মারাত্নক রোগ হয়ে থাকে।

২। অতিরিক্ত ঔষধসেবন
অতিরিক্ত ঔষধ খাওয়ার কারণে লিভার তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শুধুমাত্র শুধু নয় হার্ব, ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি লিভারের কাজের ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়ে থাকে। লিভারের ক্ষতি করতে পারে এমন একটি ঔষধ এ্যাসিটামিনোফেন যা টাইনল(Tylenol) নামক পরিচিত। এটি ঠান্ডা, জ্বরের জন্য ব্যবহৃত ঔষধে থাকে। এটিকে নিরাপদ ড্রাগ মনে করা হয়। তবে অতিরিক্ত সেবনে এটি লিভারের ক্ষতি সাধন করে থাকে। তাই জ্বর ঠান্ডা হলেই ঔষধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

৩। ধূমপান
কথিত আছে “ধূমপান বিষপান”। এই ধূমপান আপনার লিভারের ক্ষতি করার জন্য দায়ী। সিগারেট সরাসরি লিভারে প্রভাব ফেলে থাকে। সিগারেটের উপাদান সরাসরি লিভারে প্রভাব ফেলে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস উৎপাদন করে থাকে। এই অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ফাইব্রোসিস এর মাধ্যমে লিভারের টিস্যু নষ্ট করে থাকে। শুধু তাই নয় এটি লিভারের দৈনিক কার্যাবলীর মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে থাকে।

৪। অপর্যাপ্ত ঘুম
অনেকের অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে। এই অনিদ্রার সমস্যা বা অপর্যাপ্ত ঘুম আপনার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়ে থাকে। Journal of Anatomy থেকে জানা যায়, অপর্যাপ্ত ঘুম অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি করে। আরেক গবেষণায় University of Pennsylvania School of Medicine প্রকাশ করে যারা রাতে ঘুমের সমস্যায় ভুগে থাকেন তারা ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এর পাশাপাশি লিভার সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগে থাকেন।

৫। ওবেসিটি এবং পুষ্টিকর খাবারের অভাব
ওবেসিটি অন্যান্য শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি লিভারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে দিয়ে থাকে। লিভার সাধারণত রক্তের চিনি এবং চর্বির পরিমাণ প্রক্রিয়া এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অতিরিক্ত খাবার, চিনি বা চর্বি লিভার প্রক্রিয়া করতে পারে না। যার কারণে লিভারের চারপাশে চর্বি জমে থাকে। পুষ্টিকর খাবার যেমন শাক সবজি, ফল না খাওয়া, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড খাওয়ার কারণেও লিভারে চর্বি জমে থাকে।


লিভার সুস্থ রাখার উপায় কি 

লিভার। শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সুস্থ থাকতে লিভারের খেয়াল রাখতেই হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লিভার খারাপ হওয়ার কারণ হয় কিছু বদ অভ্যাস। জেনে নিন লিভার সুস্থ রাখার ১০টা সহজ নিয়ম।

১। লো ফ্যাট ফুডে ‘না’:-
ফ্যাটি লিভারের সমস্যা এড়াতে অতিরিক্ত মদ্যপান, তেল-মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত্ ঠিকই, তবে লো ফ্যাট ফুড হইতে সাবধান। সুপারমার্কেটে গিয়ে লো ফ্যাট বা ৯৯ শতাংশ লোয়ার ইন ফ্যাট লেখা ফুড কেনা অবিলম্বে ত্যাগ করুন। এই সব খাবার থেকে ফ্যাট বাদ দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু স্বাদ ধরে রাখতে যোগ করা হয় প্রচুর পরিমাণ চিনি। এতে লিভারের সমস্যা আরও বেড়ে যায়।

২। স্ট্রেস থাকলে খাবেন না:-
বোর হলে, এনার্জি কম লাগলে কী করি আমরা? অনেকেই এই সময় খাবার খেয়ে মুড ঠিক করতে চান। চিকিত্সকরা জানাচ্ছেন লিভার সুস্থ রাখতে স্ট্রেসের সময় খাবার ছোঁবেন না। এই সময় হজম ঠিক মতো হয় না।

৩। হার্বাল কেয়ার:-

শুনতে অদ্ভুত লাগলেও বেশ কিছু গাছের মূল রয়েছে যা লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ড্যানডেলিওন, মিল্ক থিসল বা হলুদের মূল লিভারের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সাহায্য করে।

৪। সাপ্লিমেন্ট:-

প্রোটিন বা ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার সময় সতর্ক থাকুন। এমন সাপ্লিমেন্ট বাছুন যা লিভার ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি লিভার পরিষ্কার রাখে। প্রোটিনের মধ্যে থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিডও লিভার পরিষ্কার রাখার জন্য ভাল। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

৫। ওষুধ থেকে সাবধান:-

বেশি কিছু ওষুধ লিভারের ক্ষতি করে। এ সব ওষুধ থেকে দূরে থাকুন। কিছু পেনকিলার, যেমন টাইলেনল বা কোলেস্টেরলের ওষুধ লিভারের প্রভূত ক্ষতি করে।

৬। কফি:-

চা, কফি খেলে শরীরের ক্ষতি হয় এই কথাটা কত বার শুনেছেন? কফি খাওয়ার কিন্তু অনেক সুফল রয়েছে। গবেষণা জানাচ্ছে, নিয়মিত কফি খেলে লিভারের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্তত ১৪ শতাংশ কমে যায়।

৭। টক্সিন:-

ত্বকে বিষক্রিয়া লিভারের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। ত্বকের মাধ্যমে বিষ রক্তে শোষিত হয়। তাই স্প্রে, টক্সিন থেকে দূরে থাকুন।

৮। প্লান্ট প্রোটিন:-

লিভার সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বেশি জরুরি সঠিক খাবার বাছা। অ্যানিমাল প্রোটিনের থেকে লিভারের জন্য বেশি ভাল প্লান্ট প্রোটিন। ডাল, সবুজ শাক-সব্জি, বাদাম, ফাইবার খান।

৯। ইজি বুজিং:-

অ্যালকোহল লিভারে টক্সিন জমা করে। ফলে অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের ক্ষতি করে। তবে হালকা অ্যালকোহল শরীরের পক্ষে ভাল।

১০। হেলদি ফ্যাট:-

ফ্যাট শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই লিভার সুস্থ রাখতে ফ্যাট ডায়েট থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দেবেন না। হেলদি ফ্যাট খান। অলিভ, ওয়ালনাট জাতীয় খাবারে হেলদি ফ্যাট থাকে।


লিভারের সমস্যা হলে কি খেতে হয়

যাদের লিভার সুস্থ আছে তারা কিছু খাবার নিয়মিত খেলে রোগব্যাধি এ অঙ্গটি থেকে দূরে থাকবে। যেমন-

লেবুর গরম পানি :-  অন্যান্য খাবারের তুলনায় কুসুম গরম পানিতে লেবু চিপে খাওয়ার অভ্যাস লিভারে অনেক বেশি এনজাইম উৎপাদনে সহায়তা করে, এছাড়াও ভিটামিন সি গ্লুটেথিয়ন নামক যে এনজাইম উৎপন্ন করে তা লিভারের ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে লিভার পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে ১ গ্লাস কুসুম গরম পানিতে সামান্য লেবু চিপে পান করুন। এতে করে লিভার পরিষ্কার থাকবে।

সবুজ চা :-  সবুজ চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের দেহের ফ্রি সার্জিকেল টক্সিসিটি দূর করে এবং আমাদের লিভার পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন ১-২ কাপ সবুজ চা পান করার ফলে লিভারে জমে থাকা টক্সিন দূর হয়ে যায় এবং পুরো দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়।


রসুন :-  রসুনে রয়েছে সালফারের উপাদান যা লিভারের এঞ্জাইমের সঠিক কাজে সহায়তা করে। এছাড়াও রসুনে রয়েছে অ্যালিসিন ও সেলেনিয়াম যা লিভার পরিষ্কারের পাশাপাশি লিভারের সুস্থতা নিশ্চিত করে। তাই খাবারে প্রতিদিন রসুন ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

হলুদ :-  লিভারের সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য উপাদান হলুদ। হলুদ একটি নিরাময় ওষুধ হিসেবে বিবেচিত। এলিভারের ডিটক্স এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে, লিভারকে পরিষ্কার করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে সেইসঙ্গে আমাদের ইমিউন সিস্টেম এর জন্য ব্যবহার করা হয় হলুদ। এটা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে।

আপেল :- পেক্টিন নামক এক প্রকার উপাদান রয়েছে আপেলে। যা শরীরের খারাপ উপাদানগুলো দূর করে ও পরিপাকতন্ত্রকে টক্সিনমুক্ত করে। লিভারকেও টক্সিনমুক্ত করার কারণে, লিভার সঠিকভাবে কাজ সম্পন্ন করতে পারে।

সবুজ শাকসবজি :- লিভারকে পরিষ্কার ও সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে সব থেকে ভাল খাবার হল সবুজ শাকসবজি। সবুজ শাক রান্না করে বা জুস করে খেতে পারেন। এটিতে রক্তের টক্সিন মুক্ত রাখার উপাদান রয়েছে।


লিভারের সমস্যায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে জেনে নিন এই ঘরোয়া সমাধান


প্রয়োজনীয় উপাদান:

  • ১২৫ গ্রাম সতেজ বাঁধাকপি

  • ১টি লেবু

  • ২৫ গ্রাম সতেজ পুইশাক

  • ২৫০ গ্রাম সতেজ নাশপাতি

  • এক টুকরা আদা (২ সে.মি. লম্বা)

  • ৫০০ মিলি লিটার পানি

  • ১০ গ্রাম পুদিনা পাতা


প্রস্তুত করার নিয়ম:-

বাঁধাকপি, পুইশাক, নাশপাতি এবং পুদিনা পাতা ছোট ছোট টুকরা করে কেটে নিন। অর্ধেকটা পানি মেশান। এর পর ব্লেন্ডারে দিয়ে ভালো করে ব্লেন্ড করুন। পুরোপুরি ব্লেন্ড হয়ে গেলে লেবুর রস এবং বাকি পানি টুকু দিয়ে দিন। এর পর আবার ব্লেন্ড করুন। ব্যস হয়ে গেল। এবার গ্লাসে ঢেলে খেয়ে নিন। ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিদিন দুবার করে খাবেন। সকালে এবং সন্ধ্যায়। এতে আপনার লিভারসহ সম্পূর্ণ শরীর থেকে টক্সিন দূর হয়ে যাবে। নিজেকে বেশ সতেজ মনে হবে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.