আর্থ্রাইটিস রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
হাঁটু ও হাতে ব্যথা আর্থ্রাইটিস রোগের চিকিৎসা
যেকোনো বয়সের পুরুষ কিংবা মহিলা- যে কারো হতে পারে আর্থ্রাইটিস বা গ্রন্থিবাত বা সন্ধিপ্রবাহ। প্রতি পাঁচজনে একজন লোকের আর্থ্রাইটিস থাকে। এটি নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়- অস্থিসন্ধি, অস্থিসন্ধির পাশের মাংসপেশি, টেনডন ইত্যাদির অনেকগুলো অসুখকে একসঙ্গে আর্থ্রাইটিস বলে। সবচেয়ে বেশি মানুষ অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সমস্যায় ভুগে । সাধারণত অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণে কোমর, হাঁটু ও হাতে ব্যথা হয়।
অস্টিও আর্থ্রাইটিস এর কারণ
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে হাতের কবজিসহ শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথা বেশি হয়, তুলনামূলকভাবে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা কম হয়। অস্টিওআর্থ্রাইটিস অস্টিওআর্থ্রাইটিস ধীরে ধীরে হয়। প্রাথমিক লক্ষণ হল- শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করলে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ বিনা কারণে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়, এক বা একাধিক অস্থিসন্ধি ফুলে যায় ও ব্যথা করে, অস্থিসন্ধির জড়তা বা স্টিফনেস দেখা দেয়- বিশেষ করে ঘুম থেকে ওঠার পর অথবা দীর্ঘসময় বসে থেকে ওঠার সময় এ সমস্যা হয়।
ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রমের পর অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, অস্থিসন্ধিতে কড়মড় শব্দ হয়। অস্টিওআর্থ্রাইটিস বেশি হয় হাঁটুর জয়েন্টে- উঁচু কোথাও উঠতে গেলে হাঁটুতে বেশি চাপ লাগে। হাতে ভারী বোঝা বহন করা কষ্টকর হয় এবং হাঁটু ফুলে যায়। কোমরে হলে নড়াচড়া করা কঠিন হয়- ব্যথা কোমরের সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকি, উরু এমনকি হাঁটুতেও হতে পারে।
হাতের মধ্যে বৃদ্ধাঙুলে বেশি হয়- এসময় আঙুলে ব্যথা হয়, ফুলে যায়, ঝিমঝিম করে এবং জয়েন্টের আশপাশে গোটার মতো গুটি হয়। মেরুদণ্ডে হলে ঘাড় ও কোমরে উভয় স্থানে ব্যথা হতে পারে। কখনো কখনো হাত-পা ঝিমঝিম করে।
যাদের ঝুঁকি বেশি
বয়স : বয়স ৬৫-র বেশি হলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তবে যেকোনো বয়সেও হতে পারে।
লিঙ্গ :
বয়স ৪৫-এর আগে ছেলেদের বেশি হয়, ৪৫-এর পরে মেয়েদের বেশি হয়।
আঘাত :
অস্থিসন্ধিতে যেকোনো ধরনের আঘাত পেলে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এ কারণে যারা পেশাগত কারণে শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন বা আঘাতের ঝুঁকিতে থাকেন, যেমন খেলোয়াড়, তাদের এ রোগ বেশি হয়। বেশি
ওজন :
শরীরের ওজন যাদের বেশি অস্টিওআর্থ্রাইটিস তাদের বেশি হয়। সাধারণ স্থূল শরীরের মানুষের হাঁটুতে রোগটি বেশি দেখা দেয়।
বংশগত :
কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে দেখা যায়। রোগ নির্ণয় রোগের ইতিহাস ও রোগের ধরন দেখে রোগ নির্ণয় করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। যেমন এক্স-রে, জয়েন্ট অ্যাসপিরেশন ইত্যাদি।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কি👇
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এটি এক ধরনের অটোইমিউন অসুখ। এতে শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেই আপনাআপনি কিছু টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অস্থিসন্ধির বহিরাবরণীতে (সাইনোভিয়াম) প্রদাহ হয়। এ কারণে অস্থিসন্ধি ও এর আশপাশে ব্যথা হয়, জড়তা তৈরি হয়, ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং শরীরে জ্বরজ্বর অনুভূতি হয়। এতে অস্থিসন্ধির আকারের বিকৃতিও ঘটে। এটি যত দিন যায় আরো তীব্র হতে থাকে। মাঝেমধ্যে ব্যথা ও ফোলা আপনিতেই কমে যায়, আবার বাড়ে। অস্থিসন্ধি ছাড়াও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায় চোখ, ফুসফুস ও হার্ট।
আর্থ্রাইটিস এর লক্ষণ👇
লক্ষণ রোগটি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক। তাই কখনো কখনো লক্ষণ প্রকাশ পায়, আবার কিছুদিন কোনো লক্ষণই থাকে না। সাধারণত লক্ষণ হিসেবে থাকে- * ঘুম থেকে ওঠার পর প্রায় এক ঘণ্টা বা এর চেয়ে বেশি সময় অস্থিসন্ধিসহ শরীরের কিছু অংশে ব্যথা ও জড়তা (স্টিফনেস) থাকে। * হাতের আঙুল, কনুই, কাঁধ, হাঁটু, গোড়ালি ও পায়ের পাতায় বেশি সমস্যা হয়। * সাধারণত শরীরের উভয় পাশ একসঙ্গে আক্রান্ত হয়। যেমন- হাতে হলে দুই হাতের জয়েন্টই একসঙ্গে ব্যথা করে, ফুলে যায় ইত্যাদি। * শরীর দুর্বল লাগে, জ্বরজ্বর অনুভূতি হয়। ম্যাজম্যাজ করে। * কারো কারো ক্ষেত্রে ত্বকের নিচে এক ধরনের গুটি দেখা যায়, যা ধরলে ব্যথা পাওয়া যায় না। কারণ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মূল কারণ এখনো অজানা। তবে গবেষকরা দেখেছেন, কিছু ফ্যাক্টর থাকলে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যেমন- বংশগত কারণ। যাদের বংশে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ইতিহাস আছে, তাদের রোগটি বেশি হতে দেখা যায়। পরিবেশগত কারণেও রোগটি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এ ধরনের কারণের মধ্যে আছে ইনফেকশন। রোগ নির্ণয় একই সঙ্গে অনেকগুলো অস্থিসন্ধিতে, শরীরের ডান ও বাঁ পাশে একই সঙ্গে হলে প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হয়েছে। এটি নিশ্চিত করতে আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে আছে রক্তের পরীক্ষা। ৭০-৯০ শতাংশ রোগীর রক্তে রিউমাটয়েড অ্যান্টিবডির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বাকি ১০-৩০ শতাংশের ক্ষেত্রে রক্তে অ্যান্টিবডি থাকে না। রক্তের আরেকটি পরীক্ষা, ইরাথ্রোসাইট সেডিমেন্টেশন রেটও মাঝেমধ্যে করার প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া এক্স-রেও লাগে।
আর্থ্রাইটিস এর ঔষধ
আর্থ্রাইটিস এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
Aconitum napellus :
একোনাইট ব্যথার একটি সেরা ঔষধ। সাধারণত ভয়ঙ্কর ধরণের ব্যথা, ছুড়ি মারার মতো ব্যথা, হুল ফোটানোর ব্যথা, ব্যথার চোটে দম বন্ধ হয়ে আসে, ব্যথা যদি হঠাৎ দেখা দেয় এবং ব্যথার চোটে যদি ‘এখনই মরে যাব’ এমন ভয় হতে থাকে, তবে একোনাইট খেতে হবে।
Arnica montana :
যে-কোন ধরনের আঘাত, থেতলানো, মচকানো, মোচড়ানো বা উপর থেকে পতনজনিত ব্যথায় আর্নিকা খেতে হবে। পেশী বা মাংশের ব্যথায় আর্নিকা এক নম্বর ঔষধ। শরীরের কোন একটি অঙ্গের বেশী ব্যবহারের ফলে যদি তাতে ব্যথা শুরু হয়, তবে আর্নিকা খেতে ভুলবেন না। যদি শরীরের কোন অংশে এমন তীব্র ব্যথা থাকে যে, কাউকে তার দিকে আসতে দেখলেই সে ভয় পেয়ে যায় (কারণ ধাক্কা লাগলে ব্যথার চোটে তার প্রাণ বেরিয়ে যাবে); এমন লক্ষণে আর্নিকা প্রযোজ্য। আঘাত পাওয়ার কয়েক বছর পরেও যদি সেখানে কোন সমস্যা দেখা দেয়, তবে আর্নিকা সেটি নিরাময় করবে।
Bryonia alba :
মাথা ব্যথা, জয়েণ্টের ব্যথা, হাড়ের ব্যথা, মাংশের ব্যথা, বুকের ব্যথা, বাতের ব্যথা প্রভৃতিতে ব্রায়োনিয়া সেবন করতে পারেন যদি সেই ব্যথা নড়াচড়া করলে বেড়ে যায়। ব্রায়োনিয়ার লক্ষণ হলো আক্রান্ত অঙ্গ যত বেশী নড়াচড়া করবে, ব্যথা তত বেশী বৃদ্ধি পেতে থাকে।
Rhus Toxicodendron :
Rhus Toxicodendron :
পক্ষান্তরে মাথা ব্যথা, জয়েণ্টের ব্যথা, হাড়ের ব্যথা, মাংশের ব্যথা, বুকের ব্যথা, বাতের ব্যথা প্রভৃতিতে রাস টক্স সেবন করতে পারেন যদি সেই ব্যথা নড়াচড়া করলে কমে যায়। রাস টক্সের লক্ষণ হলো আক্রান্ত অঙ্গ যত বেশী নড়াচড়া করবে, ব্যথা তত বেশী কমতে থাকে। খুব ভারী কিছু উঠাতে গিয়ে কোমরে বা শরীরের অন্য কোন স্থানে ব্যথা পেলে রাস টক্স এক নাম্বার ঔষধ।
Chamomilla :
Chamomilla :
যদি ব্যথার তীব্রতায় কোন রোগী দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়ে, তার ভদ্রতাজ্ঞানও লোপ পেয়ে যায়, সে ডাক্তার বা নার্সকে পযর্ন্ত গালাগালি দিতে থাকে; তবে তাকে ক্যামোমিলা খাওয়াতে হবে। ক্যামোমিলা হলো অভদ্র রোগীদের ঔষধ।
Colchicum autumnale :
Colchicum autumnale :
কলচিকাম গেটে বাত বা জয়েন্টের ব্যথায় ব্যবহৃত হয়। ছোট ছোট জয়েন্টের বাতে এবং বিশেষত পায়ের বৃদ্ধাঙুলের বাতের ব্যথায় কলচিকাম প্রযোজ্য। কলচিকামের প্রধান লক্ষণ হলো খাবারের গন্ধে বমি আসে এবং আক্রান্ত অঙের জোর/শক্তি কমে যায়।
Hypericum perforatum :
Hypericum perforatum :
যে-সব আঘাতে কোন স্মায়ু ছিড়ে যায়, তাতে খুবই মারাত্মক ব্যথা শুরু হয়, যা নিবারণে হাইপেরিকাম খাওয়া ছাড়া গতি নেই। শরীরের সপর্শকাতর স্থানে আঘাত পেলে বা কিছু বিদ্ধ হলে হাইপেরিকাম খেতে হবে ঘনঘন। যেমন- ব্রেন বা মাথা, মেরুদন্ড, (পাছার নিকটে) কণ্ডার হাড়ে, আঙুলের মাথায়, অণ্ডকোষে ইত্যাদি ইত্যাদি। (তবে যে-সব ক্ষেত্রে পেশী এবং স্নায়ু দুটোই আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়, তাতে আনির্কা এবং হাইপেরিকাম একত্রে মিশিয়ে খেতে পারেন।) আঘাতের স্থান থেকে প্রচণ্ড ব্যথা যদি চারদিকে ছড়াতে থাকে বা খিঁচুনি দেখা দেয় অথবা শরীর ধনুকের ন্যায় বাঁকা হয়ে যায় (ধনুষ্টঙ্কার), তবে হাইপেরিকাম ঘনঘন খাওয়াতে থাকুন।
Ledum palustre :
Ledum palustre :
সূচ, আলপিন, তারকাটা, পেরেক, টেটা প্রভৃতি বিদ্ধ হলে ব্যথা কমাতে এবং ধনুষ্টঙ্কার / খিচুনি ঠেকাতে লিডাম ঘনঘন খাওয়ান। অর্থাৎ যে-সব ক্ষেত্রে কোনকিছু শরীরের অনেক ভেতরে ঢুকে যায়, তাতে লিডাম প্রযোজ্য। এই ক্ষেত্রে লিডাম ব্যথাও দূর করবে এবং ধনুষ্টংকার হলে তাও সারিয়ে দেবে। চোখে ঘুষি বা এই জাতীয় কোনো আঘাত লাগলে লিডাম এক ঘণ্টা পরপর খেতে থাকুন। বাতের ব্যথায় উপকারী বিশেষত যাদের পা দুটি সব সময় ঠান্ডা থাকে।
Pulsatilla pratensis :
Pulsatilla pratensis :
পালসেটিলা’র ব্যথার প্রধান লক্ষণ হলো ব্যথা ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করে। আজ এক জায়গায় তো কাল অন্য জায়গায় কিংবা সকালে এক জায়গায় তো বিকালে অন্য জায়গায়।
Lac caninum :
Lac caninum :
ল্যাক ক্যান এর ব্যথার প্রধান লক্ষণ হলো ব্যথা ঘনঘন সাইড/ পার্শ্ব পরিবর্তন করে। আজ ডান পাশে তো কাল বাম পাশে কিংবা সকালে সামনের দিকে তো বিকালে পেছনের দিকে।
সতর্কতাঃ👉👉 চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া ঝুকিপূর্ণ।
এই আর্টিকেলটি যদি আপনার বিন্দু মাত্র উপকারে আসে তাহলেই আমার এই লেখালেখি সার্থক হবে ।
সুস্থ থাকুন সব-সময়।